
আজ থেকে ত্রিশ বছর আগের কথা।
আমাদের একমাত্র ছেলেকে নিয়ে পাগলের মতো ঘুরছি এই দ্বার থেকে সেই দ্বারে। কোথাও একটা স্কুল পাই কিনা যেখানে ছেলেকে ভর্তি করতে পারবো? নরম্যাল স্কুলে তো আর ভর্তি নেবে না। এমন সময় খবর পেলাম সল্টলেকের এ ই ব্লকে একটা স্কুল আছে যেখানে বিশেষভাবে সক্ষম ছেলেমেয়েদের শিক্ষার ব্যবস্থা আছে। দেরী না করে পৌঁছে গেলাম। জড়তা নিয়ে স্কুলের কর্তী ডাক্তার সুনীপা রায়ের ঘরে ঢুকলাম। কিন্তু আমরা ওনার মাতৃসম রূপ ও ব্যবহার দেখে ঈশ্বরকে ধন্যবাদ দিলাম যে ঠাকুর সঠিক পথ দেখিয়েছেন। সমস্যা হলো আমার বাড়ী থেকে স্কুল অনেকটা দূরে। যদিও আমার স্ত্রী ততদিনে রাস্তার ঝামেলা, লোকজনের কটু কথা, বাড়ীর ঝক্কি সামলে একটু সড়গড় হয়ে গেছে। ভোরবেলা উঠে আমার অফিসের রান্না, মা বাবার জন্য সবকিছু গুছিয়ে আমার সাথে সকাল ন’টার মধ্যে বেরিয়ে স্কুলে ছেলেকে দিয়ে মায়েদের একটা গ্রুপের সাথে সময় কাটাতো। কখনও স্কুলের ফাঁকা পরিসরে, রোদ বৃষ্টি ঝড়ে। পরে ডাক্তার আন্টির সহযোগিতায় ওনার একটা বাড়ীতে সব মায়েরা বিশ্রাম নিতো। বাড়ী থেকে যে যার মতো খাবার নিয়ে যেতো, তাই ভাগ করে খেতো। বিকেলে ছেলেকে নিয়ে বাসে করে বাড়ী ফিরতো। আমি বাসে তুলে দিয়ে যেতাম।
এমনই চলতে চলতে ডাক্তার আন্টির কাছে গিয়ে একদিন আমার স্ত্রী ভেঙ্গে পড়লো। এত দূর থেকে তো আর পারছে না।
ঠিক তখনই আরামবাগের আবাসিক স্কুলটার উদ্বোধন হলো। আমরা বাড়ীর কাউকে না জানিয়ে ছেলের জন্য আবাসিক স্কুলে এক হাজার টাকা দিয়ে নাম লিখিয়ে ফেললাম।
এক বছর পরে প্রথম যখন ছেলেকে আবাসিক স্কুলে রাখতে যাবো,তখন বাড়ীতে জানালাম। যথারীতি আবেগের বশে সবাই অনেক কথা বললো, রেগেও গেলো অনেকে কিন্তু আমরা অবিচল ছিলাম। তখন থেকেই ভাবতে শুরু করেছিলাম যে আমাদের অবর্তমানে ছেলেকে কে দেখবে?
সেই দিন এসে গেলো যখন ছেলেকে ওখানে রাখতে গেলাম। সে যে কী দুঃসহ কষ্ট হয়েছে যারা ভুক্তভোগী তারা ছাড়া কেউ বুঝবে না। ছেলেকে ছেড়ে (তখন বারো বছর বয়স হয় নি)যখন গেটের বাইরে এলাম মনে হলো পায়ের তলার মাটি সরে সরে যাচ্ছে। চোখের জলে সারা জায়গা ভিজে গেছে। চারদিন ছিল প্রথম দফায়। আমাদের সাথে কথা ছিল এই চারদিন ছেলের সাথে দেখা করতে পারবে না। আমাদের রেস্ট হাউসে থাকতে দেয়া হয়েছিল। এই চারদিন কেউ ঘুমিয়েছিলাম বলে মনে পড়ে না, ছেলেও না, আমরাও না। এমনই করে দিন চলে যেতে যেতে ছেলে একদিন আরামবাগের বাসিন্দা হয়ে গেলো। এখনও ওখানে দেখা করতে গেলে আমাদের ছাড়তে কষ্ট হয়, তবুও প্রথম দিকের মতো আর কাঁদে না আর “ভাগ্য, কপাল…” বলে আমাদের বুকের রক্ত জল করে দেয় না। একটু বুঝিয়ে বললে ঘরে চলে যায়। তবে শুনেছি বিকেলে বসার ঘরে এসে জিজ্ঞাসা করে- “বাবা চলে গেলো?”
কেন থাকতে চায় আবাসিক স্কুলে, এটা মিলিয়ন ডলার প্রশ্ন।
বিশাল জায়গা জুড়ে এই আবাসিক স্কুল। ফুলের বাগান, সব্জি বাগান, আম, জাম, জামরুল, কাজু বাদাম, পেয়ারা সব আছে। বিরাট সবুজ মাঠ আছে। ছুটে বেড়িয়ে ছেলেমেয়েরা সময় কাটায়। সময় মতো খাওয়া, সময় মতো বিশ্রাম, স্বাস্থ্য পরীক্ষা, বছরে একবার রাজসিকভাবে ঘুরতে যাওয়া।
এ সব আমরা বাড়ীতে কি দিতে পারি? তাছাড়া একত্রে হৈচৈ করতে করতে ঘুরতে যাবার আনন্দই আলাদা। পুরী, দীঘা, দেওঘর, লক্ষনৌ, অযোধ্যা কোথায় যায় নি ওরা? আমাদের ছেলের ক্ষেত্রে কোথায় যাচ্ছে সেটা বড় কথা নয়, কোথাও তো যাচ্ছে সেটাই বড় কথা।
একটা ঘটনা বলে শেষ করবো।
ছোটবেলায় আমাদের ছেলে একবার পেট্রোলিয়াম জেলির কৌটো খুলে সমস্ত কৌটোর জেলি আঙ্গুলে নিয়ে সারা ঘরের মেঝেতে ছড়িয়ে ফেলেছিল। স্ত্রী রান্নাঘরে ব্যস্ত ছিল । আমি অফিসে। স্ত্রী যখন দেখতে পেল তৎক্ষণাৎ ওকে সরিয়ে নিয়ে এলো ।পাছে জেলি ছড়ানো মেঝেতে আছাড় খেয়ে আরেকটা বিপত্তি ঘটায় । রাগে, দুঃখে , মাটিতে পা ঠুকে চিৎকার করে, জাগতিক সব বস্তুর প্রতি অভিমানে ছেলেকে বলেছিল ‘ তুই কি রে’ ?
যাবতীয় রাগের অবসান ঘটিয়ে তৎক্ষণাৎ ছেলে উত্তর দিয়েছিল ‘ আমি মানুষ।‘
প্রবীর মন্ডল ।